- খেলনা-প্রসাধনী আর পোশাকের স্টলে ঠাসা
- স্টল বরাদ্দে অনিয়ম
- সচেতন নাগরিকদের ক্ষোভ
- জনদুর্ভোগ কমাতে মেলা বন্ধের দাবি নগরবাসীর
কুমিল্লায় বিজয় মেলার নামে চলছে রমরমা বাণিজ্য মেলা। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের গৌরবকে সামনে রেখে মেলাটির আয়োজন করা হলেও সেখানে ঠাঁই পায়নি মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক কোনো স্টল। এ ছাড়া স্টল বসানো নিয়েও উঠেছে নানা অভিযোগ। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বাদ দিয়ে মেলায় স্টল বসাতে সুযোগ দেওয়া হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের।
বিজয় মাসের এই মেলাকে ‘বাণিজ্য মেলা’ আখ্যা দিয়ে নানা সমালোচনা করছেন সচেতন নাগরিকরা। তারা বলছেন, এই মেলায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক স্মৃতির কোনো চিহ্ন নেই। অর্থের বিনিময়ে খেলা ও প্রসাধনীসহ নানা পণ্যের দোকান বসিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে মেলা।
এদিকে বিজয় মেলাকে ‘বাণিজ্য মেলায়’ রূপ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সাধারণ শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাহেব আলীসহ মেলা ব্যবসায়ী বিল্লাল হোসেনের বিরুদ্ধে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেলায় ১১৫টি স্টলের মধ্যে আকৃতি চৌধুরী নামের একজন নারীকে ৩০টি স্টল, লিপি নামে একজনকে ১৫টি, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ১৫টি এবং বাকি ৫৫টি স্টল মেলা ব্যবসায়ী বিল্লাল হোসেনকে দেওয়া হয়েছে। এসব স্টল ১০-৪০ হাজার টাকায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অথচ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিটি স্টল মাত্র ৪ হাজার টাকায় বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
এদিকে নগরীর প্রাণকেন্দ্রে আয়োজিত এই মেলার কারণে সকাল সন্ধ্যায় প্রধান সড়কসহ অলি-গলিতে ছড়িয়ে পড়েছে যানজট। এতে নগরবাসীকে দুর্ভোগ চরম পোহাতে হচ্ছে। এতে মিনিটের পথ যেতে ঘন্টারও বেশি সময় লগছে। দ্রুত মেলাটি বন্ধ ঘোষণা করে দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পেতে জেলা প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীসহ সারা দেশে থেকে আসা ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের পোশাক, সিরামিক, খেলনা ও প্রসাধনীসহ বিভিন্ন পণ্যের স্টল বসানো হয়েছে। দর্শনার্থীরা এসে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নানা বিষয় খোঁজ করছেন। তবে সেখানে এই সংশ্লিষ্ট কোনো দোকান না থাকায় তারা হতাশা প্রকাশ করছেন।
ক্ষোভ প্রকাশ করে জুলাইযোদ্ধা মো. ইয়াছিন হোসেন বলেন, বিজয় মেলার নামে বাণিজ্য মেলায় ফ্যাসিবাদকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা শুরু থেকেই এর প্রতিবাদ করে আসছি। জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সাক্ষাতও করেছি। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন মেলায় কী ধরনের অনিয়ম হয়েছে, তা খতিয়ে দেখবেন। তবে এখনো আমরা দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ দেখিনি।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মাহবুবুল আলম বলেন, সন্তানদের নিয়ে বিজয় মেলায় গিয়েছি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে তাদের জানাতে। কিন্তু হতাশ হলাম। ১৯৭১ সম্পর্কিত কোনো স্টল খুঁজে পাইনি। প্রশাসনের কাছে প্রশ্ন থাকল, কেন বিজয় মেলা নাম দেওয়া হলো? নিজ সন্তানদের কাছে লজ্জিত হয়েছি।
কুমিল্লা মহানগর এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক মো. রাশেদুল হাসান বলেন, শহরজুড়ে যানজট। সেই সঙ্গে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। নতুন ডিসি এসব বিষয় সমাধান না করে বিজয় মেলার নামে একটা বাণিজ্য মেলা দিয়ে দিল। শহরের প্রাণ কেন্দ্রে আমরা কোনো মেলাই চাই না। আমরা চাই যানজট ও ডেঙ্গু মুক্ত একটি শহর।
সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সাবেক সভাপতি বদরুল হুদা জেনু বলেন, মেলায় যে সমস্ত উপকরণ বিক্রি হচ্ছে, এটাকে কোনোভাবেই বিজয় মেলা বলা যায় না। এর আগে আমরা ১৯৮২, ৮৩ ও ৮৯ থেকে টানা কয়েক বছর বিজয় মেলা করেছি। যে বিষয়গুলো মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে, সেসব বিষয়ে প্রকাশনা থেকে শুরু করে তথ্যচিত্র, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহ্নগুলো মেলায় প্রদর্শনীতে রাখা হতো। ওই মেলায় মাত্র দুই-একটা বাণিজ্যিক ফুড স্টল ছিল। অথচ আজ বিজয় মেলা নাম দিয়ে ভেতরে কীসব বিক্রি হচ্ছে। এটা বিজয় মেলার মর্যাদা এবং সম্মান নষ্ট হয়েছে। একটি কুচক্রি মহল মেলার নামে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।
কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আহ্বায়ক নুরে আলম ভূইয়া বলেন, বিজয় মেলায় বিজয়ের চিহ্ন নেই। মেলায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কোনো তথ্য চিত্র প্রদর্শনের বিষয়েও আমাদের কিছুই জানানো হয়নি। এটা দুঃখজনক।
কুমিল্লার কান্দিরপাড় ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি আব্দুর রহমান বলেন, বর্তমানে বিজয় মেলার নামে বাণিজ্য মেলা করছে কুমিল্লা টাউন হল মাঠে। এই বাণিজ্য মেলার কারণে দোকান ব্যবসায়ীরা কোনো ভালো অবস্থানে নেই। এই মেলায় নিম্নমানের মালামাল বিক্রি করা হচ্ছে। ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। প্রশাসনকে অনুরোধ করব, অচিরেই এ মেলা বন্ধ করুন।
অভিযোগের বিষয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সাধারণ শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাহেব আলী বলেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। প্রমাণিত হলে যে শাস্তি দেওয়া হবে, মাথা পেতে নেব। ১১৫টি স্টলের মধ্যে আকৃতি চৌধুরী নামের একজন নারীকে ৩০টি স্টল, লিপি নামে একজনকে ১৫টি, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নামে ১০-১৫টি এবং বাকি স্টলগুলি মেলা ব্যবসায়ী বিল্লাল হোসেনকে দেওয়া হয়েছে। তিনি সেগুলো কাকে কত টাকার বিনিময়ে দিয়েছেন আমি জানি না।
মেলা ব্যবসায়ী বিল্লাল হোসেন বলেন, আমার বিরুদ্ধে লিখতে পারবেন, তবে কোনো লাভ হবে না। মেলায় আমার নামে স্টল বরাদ্দ নেই। ডিসি অফিস আমাকে আলোকসজ্জার দায়িত্ব দিয়েছে।
এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. রেজা হাসান বলেন, মেলায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক স্টল থাকার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কেন নেই সেটা খোঁজ নিয়ে দেখছি। তাছাড়া যারা স্টল বাণিজ্যসহ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।



