কুমিল্লা
শনিবার,১৫ নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩০ কার্তিক, ১৪৩২ | ২৩ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭

দেশখ্যাত বুড়িচংয়ের সবজির চারা

  • ২০ হেক্টর জমিতে চারা উৎপাদন
  • বিক্রয় লক্ষ্যমাত্রা ২২ কোটি টাকা
  • ফলন ভালো হওয়ায় দেশজুড়ে পছন্দের তালিকায় শীর্ষে
  • মান ধরে রাখতে মনিটরিং করছে কৃষি বিভাগ

কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার সমেষপুর গ্রাম। গোমতী নদীর অববাহিকায় বেলে দোআঁশ মাটির উর্বর বীজতলা হওয়ায় সারাদেশের সবজি চাষিদের কাছে সমেষপুরের চারা পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকে। তাই এক নামেই পরিচিত গ্রামটি। এখানে ফসলি মাঠে যত দূর চোখ যায়, শুধু সবজির চারা আর চারা। প্রতিটি জমিতে সারি সারি বেডে বাতাসে দোল খাচ্ছে নানা ধরনের সবজির চারা। চারা উৎপাদনের কারণে এই গ্রামের ঐতিহ্য ও খ্যাতি অর্ধশত বছরেরও বেশি দিন ধরে। প্রতি বছর শ্রাবণ মাস থেকে বেচাকেনা শুরু হলেও সম্প্রতি বৈরী আবহাওয়ার কারণে এবার উৎপাদন ও বেচাকেনা শুরু হয়েছে দেরিতে।

সরেজমিন সমেষপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, প্রান্তিক চারা চাষিদের কেউ জমি প্রস্তুত করছেন। কেউবা সবজির চারায় পানি ছিটাচ্ছেন। আবার কেউ বিক্রির জন্য তুলছেন চারা। কেউবা সেই চারা আঁটি বাঁধছেন। পাশে দাঁড়িয়ে পাইকারেরা। তারা গুনে গুনে চারা বুঝে নিচ্ছেন। প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এমন দৃশ্য দেখা যায় এ অঞ্চলে। সবুজ-শ্যামল দৃশ্যটি দেখে যে কারোই মন জুড়িয়ে যাবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে কুমিল্লা জেলায় প্রায় ২০ হেক্টর জমিতে ৭০০-এর বেশি কৃষক চারা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। শুধু সমেষপুর নয় বুড়িচংয়ের ডাকলাপাড়া, কালাকচুয়া, কাবিলা ও নিমসার এলাকায়ও বড় আকারে চারা উৎপাদন হচ্ছে। এ ছাড়া জেলার চান্দিনা, দেবিদ্বার, বরুড়া, চৌদ্দগ্রামসহ বিভিন্ন উপজেলায়ও চারা উৎপাদন ও বিক্রির কর্মকাণ্ড চলছে। এতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় সাড়ে ৫ হাজারেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

এই মৌসুমী প্রায় ২০ থেকে ২২ কোটি টাকার চারা বিক্রি হওয়ার আশা করছেন কৃষি বিভাগ। এই এলাকার চারার মান ভালো এবং এবং ফসল বেশি হওয়ায় দেশব্যাপি চাহিদা তুঙ্গে। এখানকার উৎপাদিত টমেটো, মরিচ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, কুমড়াসহ বিভিন্ন সবজির চারা চলে যাচ্ছে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, হবিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়। চাহিদার শীর্ষে রয়েছে কাঁচামরিচ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, লাউ ও মিষ্টি কুমড়ার চারা।

প্রতিপিস চারা বিক্রি হচ্ছে ১ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২টাকা ৫০ পয়সা পর্যন্ত। চাষিরা এসব চারা কিনে জমিতে বপন করে ফসল উৎপাদন করেন। বীজ বপনের ২০ দিনের মাথায় চারা বিক্রি হয়ে বিট খালি হয়ে গেলে নতুন করে বীজ বপন করা হয়। এভাবে প্রতিবছর ভাদ্র মাস থেকে শুরু হয়ে আশ্বিন, কার্তিক ও অগ্রহায়ণ পর্যন্ত চলে এই কর্মযজ্ঞ। চারার মৌসুম শেষ হলে এসব জমিতে টমেটো, আলু, বেগুনসহ বিভিন্ন রবি ফসল উৎপাদন করেন কৃষকরা।

সমেষপুর গ্রামের চারা চাষি কামাল হোসেন বলেন, টমেটো, কাঁচামরিচ, ফুলকপি, বাঁধাকপি ও তাল বেগুনের চারা এরই মধ্যে বিক্রি শুরু হয়ে গেছে। বাজারে নেওয়ার আগেই পাইকাররা জমির আইল থেকে নিয়ে যাচ্ছেন। এবার আবহাওয়া অনুকুলে না থাকায় চারা উৎপাদন ও বিক্রি দেরীতে শুরু হয়েছে। আশা করছি এবছর ভাল মুনাফা আর্জন করতে পারবো।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন ডাকলাপাড়ার চারা বেক্রেতা মো. আলী হোসেন জানান, বাপ-দাদাদের দেখে তিনি এই পেশায় এছেন। গত ৩০ বছর ধরে সবজির চারা উৎপান ও বিক্রি করছেন তিনি। বন্যা ও আবহাওয়ার কারণে গত দুই বছর লোকসান গুনলেও এবার ভাল লাভবান হবেন বলে তিনি জানিয়েছেন।

সমেষপুরের সাথী-বিথী নার্সারির মালিক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকে আমার বাবা ইউসুফ আলী এখানে চারা উৎপাদন শুরু করেন। ওনাকে দেখে উৎসাহিত হয়ে এখন অনেকেই চারা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। প্রায় ৪০ বছর ধরে আমি এ পেশায় আছি। সারা দেশে সমেষপুরের চারা এক নম্বার স্থানে রয়েছে। গুণগত মান ধরে রাখতে আমরাও চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। বছরে আমাদের এলাকায় অন্তত ৬ থেকে ৮ কোটি টাকার মতো চারা বিক্রি হয়।

ফরিদপুর থেকে সমেষপুরে চারা কিনতে আসা লোকমান হোসেন বলেন, কুমিল্লার সবজির চারা উন্নত জাতের। ফলনও ভালো পাওয়া যায়। যার কারণে এত দূরে চারা কিনতে এসেছি। প্রায় ২৫-৩০ বছর ধরে এখান থেকে চারা সংগ্রহ করি। তবে অন্যান বছরের থেকে আবার চারার দাম একটু বেশি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে চারা কিনতে এসেছেন বজলু মিয়া। তিনি জানান প্রতি বছর এই এলাকা থেকে চারা নিয়ে জেলার বিভিন্ন বাজারে বাজারে বিক্রি করি। কুমিল্লার চারায় ফল ভাল হওয়ায় চাহিদা প্রচুর। এখানকার চারা বিক্রি করে ভাল অর্থ উপার্জন করা যায়। তাই গত ৪০ বছর ধরে তিনি সমেষপুরে চারা সংগ্রহ করে বিক্রি করে যাচ্ছেন।

বুড়িচং উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আফরিনা আক্তার নতুন কুমিল্লাকে বলেন, চারা উৎপাদনে নিয়োজিত কৃষকদের আমরা নিয়মিত কারিগরি পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়ে থাকি। উৎপাদন বৃদ্ধি ও গুণগত মান বজায় রাখতে উপজেলা কৃষি অফিসের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও চলছে। এবার ঘন ঘন বৃষ্টিপাতের কারণে প্রাথমিকভাবে কিছু ক্ষতির আশঙ্কা থাকলেও আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে মৌসুম শেষে ভালো ফলনের আশা করা যাচ্ছে।

কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান নতুন কুমিল্লাকে বলেন, চারা উৎপাদনে কুমিল্লা দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় জেলা হিসেবে পরিচিত। এখানকার কৃষকেরা মানসম্মত সবজির চারা উৎপাদন করে থাকেন। যার কারণে সারাদেশের কৃষকরা তাদের কাছ থেকে সবজির চারা নিতে ছুটে আসেন। আমাদের পক্ষ থেকে নিয়মিত কৃষকদের প্রশিক্ষণ, বীজ নির্বাচন, পোকামাকড় দমন এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়ে সার্বিক সহায়তা করা হয়।

এই কর্মকর্তা আরও বলেন, বর্তমানে জেলার প্রায় ২০ হেক্টর জমিতে সাত শতাধিক কৃষক চারা উৎপাদনে যুক্ত রয়েছেন। চলতি মৌসুমে প্রায় ২০ থেকে ২২ কোটি টাকার চারা বেচাকেনা হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

আরও পড়ুন