কুমিল্লা
শুক্রবার,১৪ নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৯ কার্তিক, ১৪৩২ | ২২ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭

ক্যাম্পাসে জুড়ে আনন্দের উচ্ছ্বাস:

বিসিএসে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ কৃতি শিক্ষার্থীর সাফল্য

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ক্লাস, বন্ধুত্ব, স্বপ্ন আর নিরন্তর সংগ্রামের দিনগুলোর শেষে যখন কেউ বিসিএসের মর্যাদাপূর্ণ মঞ্চে নিজের অবস্থান তৈরি করে নেয়—তখন সেটি হয়ে ওঠে জীবনের এক অনন্য গৌরবগাথা। এই সাফল্যের পেছনে লুকানো থাকে অগণিত রাতের পরিশ্রম, অদম্য আত্মবিশ্বাস ও স্বপ্নপূরণের অদম্য ইচ্ছাশক্তি। বিসিএস কেবল একটি চাকরি নয়; বরং তরুণ মনের স্বপ্নপূরণের প্রতীক-যেখানে অধ্যবসায়, প্রেরণা ও দেশসেবার অঙ্গীকার এক হয়ে গড়ে তোলে জীবনের নতুন আলো।

প্রতিবারের মতো এবারও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) একঝাঁক মেধাবী শিক্ষার্থী তাদের যোগ্যতা ও মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। ৪৯তম (বিশেষ) বিসিএস ও ৪৪ তম বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফলে কুবির পাঁচ শিক্ষার্থী বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবকে আরও উজ্জ্বল করেছেন। এই অর্জন শুধু ব্যক্তিগত নয়—এটি পুরো ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে দিয়েছে আনন্দের উচ্ছ্বাস ও গর্বের আবেশ।

এই সাফল্যের শীর্ষে রয়েছেন মো. অলি উল্লাহ—যিনি ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে ৪৯তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সারাদেশে প্রথম স্থান অর্জন করে কুবির ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার এ অর্জন বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্বকে বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে।

৪৯ তম বিসিএসে বাংলা বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মুসাহিদ আহমেদ শিক্ষা ক্যাডারে, অর্থনীতি বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আরজিনা আক্তার শিক্ষা ক্যাডারে, এবং রসায়ন বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আশিকুর রহমান ভূঁইয়া শিক্ষা ক্যাডারে (রসায়ন) সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। এছাড়া আইসিটি বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আরাফাত হোসেন মজুমদার ৪৪তম বিসিএস-এ “পরিবার পরিকল্পনা” ক্যাডারে স্থান করে নিয়েছেন।

এই পাঁচ কৃতি শিক্ষার্থীর সাফল্য কেবল তাদের ব্যক্তিগত জীবনের জয় নয়—এটি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীর মুখে এনে দিয়েছে গর্বের হাসি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটি এক উজ্জ্বল সংযোজন, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে প্রেরণার বাতিঘর হয়ে থাকবে।

‘প্রথম হওয়ার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো না’

প্রথম হওয়ার যে অনুভূতি তা আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আমি এটা নিয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত, পাশাপাশি আমার বাবা-মা, ভাই-বোন, আমার এলাকা, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র জুনিয়র, আমার শিক্ষক সবাই আমাকে যে ভালোবাসা দিয়েছে এটাতে আমি সিক্ত। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়কে কিছু উপহার দিতে পেরে আমি গর্বিত।

আমি সবসময় বিশ্বাস করি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবে। সেখানে আমার সিনিয়র জুনিয়র আমার থেকেও আরো ভালো কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বয়ে আনবে, আমি সবসময়ই এই আশা ব্যক্ত করি।

মো. অলি উল্লাহ
(গণিত বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়)
৪৯ তম বিসিএস (স্পেশাল) শিক্ষা ক্যাডার (গণিত)।

‘সবসময় নিজের পরিশ্রমকে বিশ্বাস করতাম’

“অভাব, আপ্রাপ্তি ও অপূর্ণতাকে আমার কাছে মনে হয় জীবন পরিবর্তনের অন্যতম পরশ পাথর। সংকট থেকেই তৈরি হয় অদম্যকে ছুঁয়ে দেখার কৌতুহল। প্রথম সেমিস্টারে বাবা মারা যান। নিজের পড়ালেখার খরচ-পরিবারের ভরনপোষণ আর চতুর্মুখী সংকট জীবনকে যেন থামিয়ে দিবে। কিন্তু আমি দমে যাইনি। এই সংকটকে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে চেয়েছি। স্বপ্ন ছিলো একটাই, বিসিএস এর মতো বড় স্টেজে নিজেকে খুজে পাওয়া।এর জন্য কতশত রাতজাগা, হাসিমুখে কষ্ট মেনে নেয়া, প্রতিকূলতাকে সহজেই মেনে নিয়েছি। কঠোর পরিশ্রমকে আপন করে নিয়েছি। বারবার ভেবেছি আমাকে দিয়ে অবশ্যই হবে।”

আর্টসের স্টুডেন্ট হওয়াতে সাইন্স, ম্যাথ, আইসিটি নিয়ে খুব বেশি সমস্যা হতো। তবু এই দুর্বলতা কাটানোর অদম্য প্রয়াস অনেকটা সাহস যুগিয়েছে।একাডেমিকের পাশাপাশি সবসময় চেয়েছি যেনো জবের পড়াতে অন্যদের চাইতে এগিয়ে থাকা যায়।

সবসময় নিজের পরিশ্রমকে বিশ্বাস করতাম। শুরু থেকে কেবল এটাই ভেবেছি যে, পরিশ্রমীরা কখনো হারেনা আর তাদের হারানোর কিছু নাই।

আমার কাছে সবসময় মনে এই যে অভাব,অপ্রাপ্তি , অপূর্ণতা এগুলো ছিল বলেই আমি অন্যদের চাইতে নিজেকে এগিয়ে রাখতে পেরেছি। ভেবেছি এগুলোই আমার সাহস। আমার শক্তি। আমার সাফল্যের সবটুকু জুড়ে আছে পরিশ্রম আর অদম্য ইচ্ছাশক্তি।

আমি জুনিয়রদের বলবো এই স্টেজে পারফর্ম করতে হলে লাগবে বুক ভরা সাহস। নয়তো এখানে ভালো করার চান্স অনেক কম। লেগে থাকলে সফলতা আসবেই। এটা অনিবার্য। তাও ভয় পাওয়ার কিছু নাই শুধু হার না মানার মানসিকতা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাও। জয় তোমারই হবে।
মুসাফির আহমেদ
(বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়)
৪৯ তম স্পেশাল বিসিএস (প্রভাষক, বাংলা)

‘লালায়িত স্বপ্নকে ছুতে পারার অনুভূতি সত্যিই অসাধারণ’

বিশ্বাস ছিল পারব। তাই সব কিছু বাদ দিয়ে শুধু বিসিএস কেন্দ্রিক পড়াশোনা শুরু করি। আল্লাহ আমাকে নিরাশ করেন নি। নিজের ছোটকালের লালায়িত স্বপ্নকে ছুতে পারার অনুভূতি সত্যিই অসাধারণ।

লক্ষ্য স্থির রেখে ছোট ছোট পরিকল্পনা মাফিক ধারাবাহিক পড়াশোনা এবং সাথে ধৈর্য ও আল্লাহর উপর ভরসা করে এগিয়েছি।

আমার এই সফলতার পিছনে আমার পরিবার, বন্ধু- বান্ধব এবং আমার সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দদের অবদান অনস্বীকার্য। আমি উনাদের প্রতি,, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি চির কৃতজ্ঞ।

নবীনদের উদ্দেশ্যে এতটুকুই বলব,
প্রথমে লক্ষ্য স্থির করা এবং ধারাবাহিক পড়াশোনা করা। সব সময় মনে রাখবেন, ‘ফেইলুর ইজ দ্য পিলার অব সাকসেস’। ব্যর্থতাকে শক্তিতে রুপান্তর করে নিজের স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

আরজিনা আক্তার
(অর্থনীতি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়)
৪৯ তম বিসিএস ( স্পেশাল) শিক্ষা ক্যাডার।

‘আমি বিশ্বাস করি, পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না’

মহান আল্লাহর অশেষ রহমত এবং আমার বাবা মা এর দোয়ায় ক্যাডার হতে পেরেছি। অনার্স লাইফের শেষ থেকেই আমি বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। ধৈর্যের সাথে সঠিক পদ্ধতিতে পরিশ্রম করেছি, নিজের দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করে সেগুলো উত্তরণের চেষ্টা করেছি। বিসিএস একটা লম্বা জার্নি, এই জার্নিতে উত্থান পতন ছিলো কিন্তু হতাশ হইনি কখনো। সেই সাথে আত্মবিশ্বাস ছিল। আমি বিশ্বাস করি, পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না।

মোহাম্মদ আশিকুর রহমান ভূঁইয়া (রসায়ন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়)
৪৯তম স্পেশাল বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার (রসায়ন)।

‘অধ্যবসায়ীরা কখনও ব্যর্থ হয় না’

সত্যি বলতে বিসিএস ক্যাডার হওয়াটা আমার স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন যখন সত্যি হয় তখন সেটা আসলে অন্যরকম অনুভূতি। আর এই স্বপ্নকে সত্যি করার পেছনে আমার পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও পরিকল্পনা বেশি ভূমিকা পালন করেছে বলে আমার মনে হয়।আমার এই প্রাপ্তিতে আমার চেয়ে আমার বাবা শতগুণ বেশি খুশি হয়েছেন। বিশেষ করে এসএসসি পর্যন্ত আমার পড়ালেখার উন্নতির জন্য সবচেয়ে বেশি অবদান আমার বাবারই। তিনি সবসময় ছায়ার মত সঙ্গী হয়ে থেকেছেন। আমি আমার পরিবার,শিক্ষক,বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষী সকলের নিকট কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। একজন আদর্শ পিতার আদর্শ সন্তান হিসেবে আমি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই আর দেশমাতৃকার কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করতে চাই।সকলের নিকট দোয়াপ্রার্থী।

বিসিএস আসলে ধৈর্যশীল মেধাবীদের জন্য। তাই জুনিয়রদের প্রতি আমার তিনটি পরামর্শ থাকবে-
১. নিজের মেধার সর্বোত্তম ব্যবহার করুন।
২. নিজের লক্ষ্য ঠিক করুন এবং বিশ্লেষণমূলক পড়াশোনা করুন। নিজের দুর্বল ও সবল দিকগুলো চিহ্নিত করুন এবং আপনার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করুন।
৩. পাঠ্যবইয়ের বাইরেও শেখার অনেক কিছু আছে। সকল উৎস থেকে জ্ঞান আহরণ করুন এবং তা কাজে লাগান।

অধ্যবসায়ীরা কখনও ব্যর্থ হয় না। তাই, চেষ্টা অব্যাহত রাখুন। ইনশাআল্লাহ সফলতা আসবেই।

আরাফাত হোসেন মজুমদার
(আইসিটি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় )
৪৪ তম বিসিএস “পরিবার পরিকল্পনা” ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত।

আরও পড়ুন