কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের ভারত সীমান্তবর্তী ছোট্ট একটি গ্রাম ‘কমলপুর’। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই এ গ্রামে শুরু হয়ে যায় বাটিকের রং-বেরঙের থ্রিপিস, শাড়ি, লুঙ্গি, বেডশিট তৈরির কর্মযজ্ঞ। গ্রামটির অধিকাংশ ঘরবাড়িই যেন বাটিকের একেকটি ছোট ছোট কারখানা। এসব কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে সহস্রাধিক শ্রমিকের। তাদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ নারী। কমলপুর থেকে কাজ শিখে পাশের আনন্দপুর, গলিয়ারা, বিবির বাজার ও ইটাল্লা গ্রামে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু কারখানা। নারী-পুরুষ শ্রমিকদের আয়ে সচ্ছলতার রং লেগেছে এসব গ্রামের পরিবারগুলোতে।
এখানকার তৈরি বাটিকের কাপড় যাচ্ছে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কেউ কাপড়ে ব্লক দিচ্ছেন, কেউ রঙের পানিতে কাপড় ভেজাচ্ছেন, কেউ কাপড় শুকাচ্ছেন, কেউ কাপড়ে রংতুলির আঁচড় দিচ্ছেন, কেউবা এমব্রয়ডারির কাজে ভীষণ মনোযোগী। গ্রামের পথে পথে নানা রঙের প্রদর্শনী। লাল, সবুজ, হলুদ বিভিন্ন রঙের কাপড় শুকানো হচ্ছে। বাটিক কাপড়ের নানা রঙে বর্ণিল এসব গ্রামে যেন রংধনুর সাতরঙের মেলা।
কয়েক জন কারিগর জানান, বেশির ভাগ সময় বাটিকে প্রাকৃতিক রঙ ব্যবহার করা হয়। নীল, তুঁতে, গাঁদাফুল, শিউলীফুল, পেঁয়াজের খোসা, হরীতকী, খয়ের ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপাদান থেকে বিশেষ উপায়ে রং তৈরি করে তা দিয়ে বাটিকের কাজ করা হয়। বাটিকের কারখানার কারিগর ননী গোপাল জানান, তার বাড়ি নোয়াখালীর বসুরহাটে। তিনি ৩৮ বছর ধরে কাজ করেন।
এখানে অনেক শ্রমিক কাজ করে তারা পরিবার চালাচ্ছেন, সন্তানের লেখাপড়া করাচ্ছেন। তাদের পরিবারে সচ্ছলতা এসেছে। নগরীর বাটিক কর্ণারের ব্যবসায়ী নিজাম উদ্দিন বলেন, এখানের বাটিকের কাপড় দৃষ্টিনন্দন, টেকসই ও সাশ্রয়ী মূল্যে বিক্রি হয়। বাটিকের সালোয়ার-কামিজ (সেলাইবিহীন) ৪৫০-২ হাজার ৫০০ টাকা, শাড়ি ১ হাজার ২০০-৬ হাজার টাকা, ফতুয়া ৪৫০-১ হাজার ৫০০ টাকা, স্কার্ট ২৫০-১ হাজার ২০০ টাকা, ওড়না ৩৫০-১ হাজার ৫০০ টাকা, স্কার্ফ ১৫০-৫৫০ টাকা, পাঞ্জাবি ৬৫০-২ হাজার টাকা, শার্ট ৪৫০-১ হাজার ২০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। এ ছাড়াও প্রতি গজ কাপড় ১১০-৪৫০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়ে থাকে। তবে স্থানভেদে এই দামে তারতম্য হতে পারে।
হাসি বাটিকের মালিক মো. আবু হানিফ বলেন, ‘কুমিল্লার বাটিক লুঙ্গি, শাড়ি, থ্রিপিসের সুনাম দেশজোড়া। আমরা বংশপরম্পরায় এ ব্যবসা করছি। বাইরে থেকে কাপড় কিনে এনে তার ওপর ডিজাইন ও রং করে বিক্রি করি। কাপড়ের মান ভালো, রং পাকা।’ বাটিক রঙের কারিগর জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘আমি প্রডাকশনে কাজ করি। কাজ বুঝে টাকা, যে বেশি কাজ করতে পারে, তার প্রডাকশন বেশি তার টাকাও তত বেশি। প্রতিদিন ৮০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত রোজগার করতে পারি।’
দেলোয়ারা ডাইংয়ের মালিক মো. সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন কারখানা থেকে সাদা কাপড় সংগ্রহ করা হয়। পরে ডাইংয়ে এনে রংতুলিতে আলপনার কাজ করা হয়। টেকসই রং ও মানের জন্য বাটিক কাপড়ের প্রতি ক্রেতাদের আস্থা ও চাহিদা বছরের পর বছর বৃদ্ধি পেয়েছে। আমার এখানে প্রায় ৫০ জন কাজ করে।’ খাদি কাপড়ের নামকরা ব্যবসায়ী প্রদীপ কুমার রাহা বলেন, ‘দিন দিন তাদের ব্যবসা প্রসার লাভ করছে। বিভিন্ন কোম্পানি এখানে অর্ডার দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়।
এখানকার বাটিকের কাপড় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও নরসিংদীসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়।’ বাটিকশিল্প নিয়ে কাজ করা তফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘কমলপুরসহ আশপাশের বাটিকপল্লি কুমিল্লাকে বিশ্বময় পরিচিত করেছে। এই কাপড়ের দাম কম হলেও এর ব্যবহার গ্রাম থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকার বেশ কিছু পাইকারি ব্যবসায়ী আমাদের কাপড় নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছে।’
কুমিল্লা নাগরিক ফোরামের সভাপতি কামরুল আহসান বাবুল বলেন, ‘সব বয়সের ও সব ধরনের গায়ের রঙের মানুষের জন্য মানানসই বাটিক। বাটিকের পোশাক দেখতে যেমন ফ্যাশনেবল, তেমনি আরামদায়কও।’ বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কুমিল্লার উপমহাব্যবস্থাপক মো. মুন্তাসীর মামুন বলেন, ‘কুমিল্লার বাটিক কাপড়ের বেশ কদর ও সুনাম রয়েছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলা ও প্রদর্শনীতে এখানকার পণ্য যাচ্ছে।’




